এশার নামাজ পড়িয়ে খুন, লাশ গুম করে পড়ালেন ফজরের নামাজ

বাংলা ট্রিবিউন •

গত ১৯ মে এশার নামাজে ইমামতি করেন আব্দুর রহমান। এরপর পোশাক শ্রমিক মো. আজহারুল ইসলামকে (২৮) মসজিদে নিজের শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিতে বলেন। সেই কক্ষে ইমামের সঙ্গে আজহারের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় ছুরি দিয়ে আজহারকে আঘাত করেন আব্দুর রহমান। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন আজহার। কিন্তু পারেননি। সিঁড়িতেই কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন আব্দুর রহমান। এরপর নিজের কক্ষে নিয়ে যান লাশ। সেখানে ছয় টুকরো করেন। এরপর মসজিদের অজুখানার পাশে থাকা সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন লাশের টুকরোগুলো। ট্যাংকের মুখের ঢাকনা সিমেন্ট দিয়ে আটকেও দেন রাতারাতি। পানি ঢেলে ধুয়ে দেন রক্ত। এরপর ফজরের নামাজে ইমামতি করেন। মূলত আজহারের স্ত্রী আসমা আক্তারের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার সরদারবাড়ি মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমান।

বুধবার (২৬ মে) বিকালে র‌্যাব সদর দফতরে এসব তথ্য জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

দক্ষিণখানের সরদারবাড়ি মসজিদে ৩৩ বছর ধরে ইমামতি করছেন আব্দুর রহমান। ওই এলাকায় পোশাক শ্রমিক আজহার তার স্ত্রী ও চার বছরের সন্তান নিয়ে ভাড়ায় থাকতেন। ইমামের কাছে আজহার নিজে ও তার সন্তানকে কোরআন শেখাতেন। মসজিদের কাছেই আজহারের বাসা। আব্দুর রহমানের যাতায়াত ছিল সেখানে। যার ফলে তার সঙ্গে আজহারের স্ত্রী আসমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা কয়েক মাস আগে আজহারের কাছে ধরা পরে।

এরপর আজহার বিষয়টি ইমামকে জানান। কিন্তু আজহারের কথা মানতে নারাজ আব্দুর রহমান। এরপর আজহার তার স্ত্রীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

এর মধ্যে আব্দুর রহমানকে আসমা ফোন করে জানান তাকে বাড়ি থেকে আর ঢাকায় ফেরত আনবে না বলে জানিয়েছে আজহার। তাই আব্দুর রহমানকে কিছু একটা করতে বলেন আসমা। আব্দুর রহমানের পরামর্শে নতুন সিম নেন আসমা। তাতেই কথা হতো তাদের। আসমা ফোনে আব্দুর রহমানকে বলেন, ‘আজহারকে খুন করেন। তা না হলে আমি আত্মহত্যা করবো।’

এরপরই খুনের পরিকল্পনা করেন আব্দুর রহমান। রোজার সাত দিন আগে পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। সেই অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণখানের সরদারবাড়ি মসজিদের নিজের কক্ষে ডেকে খুন করা হয় আজহারকে।

আজহারকেও পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন আসমা

আসমার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতীতে। অল্প বয়সে এক কৃষকের সঙ্গে এলাকায় বিয়ে হয়েছিল তার। তবে তা বেশিদিন টেকেনি। এরপর কালিহাতীতে দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০১৬ সালের দিকে। কিন্তু এটাও টেকেনি। ওই দ্বিতীয় স্বামীর ছোটভাই আজহারেরর সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক হলে দুজনে পালিয়ে ঢাকার উত্তরায় চলে আসে। বিয়ে করে তারা দক্ষিণখানে থাকতে শুরু করেন। এ সময় এক সন্তানের বাবা-মা হয় এ দম্পতি।

এরমধ্যেই আব্দুর রহমানের সঙ্গে আসমার গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। র‌্যাবের মিডিয়া ও আইন শাখা উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ওই ইমামের সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে আসমার প্রেমের সম্পর্ক হয়। আজহারকে হত্যার পর তাদের বিয়ে করার পরিকল্পনা ছিল।’

মসজিদের দোতলায় রক্তের দাগ

মসজিদে নিজের রুমে আজহারকে ১৯ মে রাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন আব্দুর রহমান। রক্তের দাগ মোছার চেষ্টা করলেও কিছু দাগ থেকে যায়। যা মুসুল্লিদের চোখে পড়ে। এতে তাদের সন্দেহ হয়।

নামাজে ভুল করেন আব্দুর রহমান

১৯ মে হত্যাকাণ্ডের পর ২০ মে থেকে নামাজে একের পর এক ভুল করতে থাকেন ইমাম আব্দুর রহমান। আগে তার কখনই ভুল হতো না বলে জানান স্থানীয়রা। অথচ ২০ তারিখ থেকেই প্রতি ওয়াক্তে কখনও সেজদায়, কখনও রুকুতে ভুল করেছেন তিনি। এমনকি সুরাতেও ভুল করতে থাকেন।

সরদার মসজিদের মুসুল্লিরা জানান, একের পর এক ভুলের কারণ তারা তখনও বুঝতে পারেননি। মূলত খুন করার পর মানসিক অস্থিরতা গ্রাস করেছিল আব্দুর রহমানকে।

আজহারের বাসায় যাওয়া বন্ধ

ইমাম আব্দুর রহমান যে বাসায় নিয়মিত ভাত খেতেন, হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ওই বাসায় যাওয়া বন্ধ করাতেও সন্দেহ হয় অনেকের। মসজিদের অজুখানা থেকে গন্ধ এবং সিঁড়িতে রক্তের দাগ দেখে ২৪ মে স্থানীয়রাই খবর দেয় র‌্যাব-১ এ। এরপর ২৫ মে ভোরে র‌্যাব ১-এর সদস্যরা গিয়ে সেপটিক ট্যাংক খুলে আজহারের ছয় টুকরো লাশ উদ্ধার করে।


হত্যার পর মসজিদে থাকতেন না ইমাম

হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ইমাম নিজের কক্ষে আর যেতেন না। পাশের একটি মাদ্রাসায় ঘুমাতেন। ওই মাদ্রাসায় শিক্ষতাও করতেন তিনি। সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘নিহত আজহারের স্ত্রী আসমাকে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে মঙ্গলবার (২৫ মে) রাতে আমরা গ্রেফতার করেছি। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেয়েছি। আজহারের স্ত্রীই এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজহারকে মেরে ফেলতে আব্দুর রহমানকে ভাড়াটে কাউকে দিয়ে হত্যা করার জন্য বলেন আসমা। কিন্তু ইমাম নিজেই হত্যা করেন।’

এদিকে মঙ্গলবার (২৫ মে) বিকালে কারওয়ানবাজার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল মোত্তাকিম।

তিনি বলেন, রাজধানীর দক্ষিণখানের বাসিন্দা আজহারের স্ত্রীর প্রতি কুনজর ছিল সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের। বিষয়টি জানার পর ইমামকে নিষেধ করতে মসজিদে যান তিনি। সেখানে যাওয়ার পর বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ধারালো ছুরি দিয়ে আজহারের গলায় আঘাত করেন ইমাম।

কী নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল জানতে চাইলে র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক আব্দুল মোত্তাকিম বলেন, আব্দুর রহমান বলেছেন- আজহার অভিযোগ করেছিলেন তার স্ত্রীর দিকে ইমামের কুনজর রয়েছে। কিন্তু আজহারের স্ত্রীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছেন ইমাম।

এর আগে র‍্যাব জানিয়েছিল, হত্যাকাণ্ডে নিহতের স্ত্রী জড়িত কি-না তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার একদিন আগে স্ত্রী আসমা তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল চলে যান। ঘটনার আগের দিন থেকে তিনি টাঙ্গাইলেই ছিলেন কি-না এবং হত্যায় তার সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এ ঘটনায় প্রেমের কোনও বিষয় জড়িত কি-না জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোত্তাকিম বলেছেন, ‘এই ঘটনায় পরকীয়ার মতো কোনও ঘটনা ঘটেছে কি-না তা যাচাই-বাছাই করছি। তবে ইমাম আব্দুর রহমান বলেছেন, আজহার তাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে এবং বলেছে তার স্ত্রীর দিকে তিনি (আব্দুর রহমান) কু-দৃষ্টি দিয়েছেন। এই কারণে তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এরপরই রাগান্বিত হয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিছু সময় আগে তার স্ত্রী আসমা বেগমকে আমাদের হেফাজতে নিয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো সম্ভব হবে।’

ধারালো অস্ত্রগুলো কীভাবে এলো জানতে চাইলে লে. কর্নেল আব্দুল মুত্তাকিম বলেন, ‘তিনি (আব্দুর রহমান) দীর্ঘদিন ধরে ওই মসজিদে চাকরি করতেন। কোরবানির পশু জবাই করার জন্য সঙ্গে দেশি অস্ত্র রাখতেন। সেটা দিয়েই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।’